বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন হিসাবের মাধ্যমে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে কম সুদে বা লাভে আমানত সংগ্রহ করে এবং অধিক সুদে বা লাভে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়। প্রাপ্ত ও প্রদত্ত সুদ বা লাভের পার্থক্যই এরূপ ব্যাংকের আয়ের প্রধান উৎস। এছাড়াও পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফট, প্রত্যয়পত্র ইত্যাদি খোলার মাধ্যমে ব্যাংক কমিশনপ্রাপ্ত হয়। গ্রাহকদের হিসাব পরিচালনার কারণে ব্যাংক চার্জ আদায়, ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং সেবার জন্য সার্ভিস চার্জ প্রাপ্তি ইত্যাদি বিভিন্ন খাতে ব্যাংক আয় করে। এক্ষেত্রে পরিচালনা খরচসহ বিভিন্ন 1112 1 % খরচ-ক্ষতি বাদ দিয়ে যা থাকে তাই ব্যাংকের মুনাফা। এই ব্যাংক জনগণের জমা রাখা আমানত বা ঋণ দিয়ে মূলত ব্যবসায় করায় একে ধার করা অর্থের ধারক, স্বল্পমেয়াদি ঋণের ব্যবসায়ী ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ব্যাংকের এসব কাজে স্বচ্ছতা ও গ্রাহকদের চাহিদা অনুসারে সেবা প্রদানে উভয়পক্ষকেই নিষ্ঠাবান হতে হবে।
এ উপ-অধ্যায়ে আমরা ব্যাংকিং সফটওয়্যার ও ঋণ প্রদানে এর ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারব।
আজকাল ব্যাংকিং কার্যক্রমের পরিধি যেমন বেড়েছে, তেমনি গ্রাহকের সংখ্যাও বেড়েছে। গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি তাদের সেবার চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি তাদের সেবার ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। শুধু তাই নয়, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার চাহিদা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যাও যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় অন্যদের চেয়ে ভালো করার জন্য ব্যাংকগুলো তাদের সেবার মান বৃদ্ধির চেষ্টা অনবরত করে যাচ্ছে। তারই ফল হচ্ছে ব্যাংকিং কার্যক্রমে প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার। গ্রাহকের চাহিদার প্রেক্ষিতে সেবার মান বৃদ্ধির নিমিত্তে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে গ্রাহকের নিকট ব্যাংকিং কার্যক্রমের যেমন স্বচ্ছতা নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনি দ্রুততম সময়ে ব্যাংকিং কার্যক্রমও সমাপ্ত হচ্ছে। এতে গ্রাহক ও ব্যাংক উভয়ের জন্যই তা ইতিবাচক ফল নিয়ে আসছে। তাই বলা যায়, যে সফটওয়্যারের মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পাদন করা হয় তাকে ব্যাংকিং সফটওয়্যার বলে।
সফলভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পাদন করার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো Core Banking Software ব্যবহার করে। এতে ব্যাংকিং কার্যক্রমের শুরু থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত সব কাজ সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা যায়। বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক এজন্য বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তৈরি সফটওয়্যার কিনে ব্যবহার করে। তবে বাংলাদেশে অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক T24 Software টি ব্যবহার করে। এটি একটি Core Banking Software। এটি অত্যন্ত মানসম্পন্ন একটি সফটওয়্যার। যার দ্বারা ব্যাংকিং কার্যক্রমের সব কিছু সম্পাদন করা যায়। এতে ব্যাংকিং কার্যক্রমের নিরাপত্তা যেমন নিশ্চিত করা যায়, তেমনি দ্রুততম সময়ে কার্যক্রম সম্পাদন করা যায়। T24 Software ছাড়াও কিছু আধুনিক ব্যাংকিং সফটওয়ার রয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবহার করে থাকে। আবার বাংলাদেশের কয়েকটি ব্যাংক নিজেদের তৈরি Core Banking Software-ও ব্যবহার করে। সুতরাং, প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে দিন দিন Core Banking Software এর উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গ্রাহকের স্বার্থে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো প্রতিনিয়ত সেবার মান বাড়িয়েই চলেছে। তারই ফলে ব্যাংকিং সফটওয়্যারের উদ্ভাবন এবং ব্যবহার বাড়ছে। নিচে ব্যাংকিং সফটওয়্যারের ব্যবহার ক্ষেত্র তুলে ধরা হলো—
→ আধুনিক সেবা-সুবিধা (Modern facilities): বাংলাদেশে আর্থিক খাতের বাজার চাহিদা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যাও তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাজার দখলের জন্য নতুনভাবে স্থাপিত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যেমন আধুনিক সেবা-সুবিধা সম্বলিত ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করছে, তেমনি সুনাম সমৃদ্ধ পুরাতন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের বাজার অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য Core Banking Software ব্যবহার করে গ্রাহকের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছে।
→ সেবার সহজপ্রাপ্তি (Ease of service ) : প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য অধুনা স্থাপিত ব্যাংকগুলো গ্রাহকের দরজায় কড়া নাড়ছে। অর্থাৎ এজেন্ট ব্যাংকিং, উপশাখার মাধ্যমে ব্যাংকগুলো জনগণের দরজায় গিয়ে ব্যাংকিং সেবা দিচ্ছে। এছাড়া গ্রাহকের আস্থা অর্জনের জন্য সফটওয়্যার ব্যবহার করে কার্যক্রমের স্বচ্ছতাও নিশ্চিত করছে।
→ উন্নতমানের ব্যাংকিং সফটওয়্যার (High quality banking software): বাংলাদেশের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করে। তার মধ্যে অধিকাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংক T24 Software ব্যবহার করে। এটি সুইজারল্যান্ডের তৈরি একটি উন্নতমানের Core Banking Software। এটি দ্বারা ব্যাংকের বাণিজ্যিক কার্যক্রমের A-Z সম্পাদন করা যায়। এর মাধ্যমে স্বচ্ছতা যেমন নিশ্চিত হয়, তেমনি কম সময়ে কার্য সম্পাদন করা যায়। এটি ছাড়াও অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংক অন্যান্য Core Banking Software ব্যবহার করে। দেশীয় ২/৩টি Core Banking Software রয়েছে, যেগুলো কয়েকটি ব্যাংক ব্যবহার করছে।
→ ঋণ অনুমোদন ( Loan approval) : ঋণ প্রদান কার্যক্রম ব্যাংকিং যাবতীয় কার্যক্রমের একটি অংশমাত্র। এই ঋণ প্রদান কার্যক্রমেও ব্যাংকিং সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ঋণের জন্য আবেদনকারীর আবেদনপত্রের সাথে সংযুক্ত প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টগুলো যাচাই করে একটি ঋণের প্রস্তাব (Loan Proposal) তৈরি করা হয়। এটি তৈরির সাথে সাথেই ঐ অ্যাপসে (CIB অ্যাপস) গিয়ে যাবতীয় তথ্য সন্নিবেশিত করতে হয়। অতঃপর ঋণদান পদ্ধতির নিয়ম মেনে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য শাখা ম্যানেজার / আঞ্চলিক ম্যানেজার / জোনাল ম্যানেজার / প্রধান কার্যালয়ে প্রেরণ করা হয়। অতঃপর তা নির্দেশিত ডেস্কে বিধি মোতাবেক আলোচনার পর পরবর্তী ডেস্কে পাঠানো হয়। এভাবে বিস্তারিত আলোচনার পর ঋণ অনুমোদন করা হয়।
→ ঋণ বিতরণ (Loan disbursement ) : ঋণ অনুমোদনের পরবর্তীতে যাবতীয় অফিসিয়াল কার্যক্রম সম্পাদনের পর তার আবেদনকারীর ডকুমেন্টগুলো যথাযথ সংরক্ষণপূর্বক Loan Disbursement-এর জন্য শাখায় প্রেরণ করা হয়। ব্যাংকের শাখা ঋণ হিসাবধারীর হিসাবে অনুমোদনকৃত ঋণের অর্থ ক্রেডিট/জমা করে। অর্থাৎ ঋণ প্রস্তাব তৈরি থেকে ঋণের অর্থ ছাড়করণের জন্য ঋণ হিসাবধারীর হিসাবে ঋণের অর্থ ক্রেডিট করা পর্যন্ত যাবতীয় কাজ এই ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে করা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে কখন কোথায় প্রস্তাবটি রয়েছে তা ঋণের আবেদনকারী জানতে পারে।
→ ঋণগ্রহীতাকে ঋণ পরিশোধের তথ্য জানানো (Inform the borrower about loan repayment information) : ঋণ অনুমোদনের পর তা কত কিস্তির মধ্যে কত টাকা করে কিস্তি পরিশোধ করতে হবে তার বিস্তারিত ঋণগ্রহীতাকে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে জানিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি প্রতিটি কিস্তি দেওয়ার পূর্বে ঋণগ্রহীতার ডিভাইসে (মোবাইল ফোন বা ই-মেইলে) ম্যাসেজ চলে যায়। ব্যাংকিং কার্যক্রমের তথা ঋণদান প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতার জন্য ব্যাংকিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে গ্রাহকের প্রয়োজনীয় সব তথ্য গ্রাহকের ডিভাইসে সরাসরি চলে যায়। এতে গ্রাহকের যেমন সন্তুষ্টি আসে, তেমনি ব্যাংকের কার্যক্রমেও গতি সঞ্চারিত হয়। বাংলাদেশের প্রায় সব বাণিজ্যিক ব্যাংক এই Core Banking Software-এর মাধ্যমে ঋণদান প্রক্রিয়া সম্পাদন করে।